আমাদের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যে এমন অসংখ্য ছাত্র-ছাত্রী আছে, যাদের জন্য শিক্ষালাভ এক দূরসম্পদ। পরিবারের দৈনন্দিন খরচ চালানোই কঠিন, তখন বই-খাতা আর টিউশন ফির কথা ভাবা আরো শক্ত। ফলস্বরূপ, ঝরে পড়ে অসংখ্য প্রতিভাবান স্বপ্ন, অন্ধকারে হারিয়ে যায় উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ।
এই অন্ধকার দূর করতেই এগিয়ে এসেছে রাজ্য সরকারের ঐক্যশ্রী স্কলারশিপ (Aikyashree Scholarship 2024)। প্রিম্যাট্রিক থেকে পোস্ট ম্যাট্রিক, প্রতিটি ধাপে এই স্কলারশিপ দিচ্ছে অর্থনৈতিক সাহায্য। পড়াশোনার খরচের কিছুটা অংশ বহন করে, যাতে শুধু পড়াশোনার দিকে মন দিয়ে একটানা এগোতে পারে ছাত্র-ছাত্রীরা, এমন উদ্দেশ্যেই এমন উদ্যোগ রাজ্য সরকারের। দারিদ্র্যের বাঁধন আর যাতে ভাঙতে পারে না তাদের স্বপ্নের উড়ান।
এই প্রবন্ধে, আমরা ঐক্যশ্রী স্কলারশিপের সবকিছু খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে আলোচনা করেছি। কারা পাবে এই স্কলারশিপ, কত টাকা দেওয়া হয়, কীভাবে আবেদন করতে হবে, কখন আবেদন করতে হয় সবকিছুই বিস্তারিতভাবে তুলে তুলে ধরা হয়েছে।
স্কলারশিপের নাম | ঐক্যশ্রী স্কলারশিপ |
সুবিধা | ১,১০০ টাকা থেকে ৩০,০০০ টাকা |
যোগ্যতা | নিম্নে উল্লিখিত |
আবেদন মাধ্যম | অনলাইন |
প্রদানকারী | পশ্চিমবঙ্গ সরকার |
অফিসিয়াল ওয়েবসাইট | wbmdfcscholarship.org |
ঐক্যশ্রী স্কলারশিপ (Aikyashree Scholarship 2024)
শিক্ষাই জাতির মেরুদণ্ড, এই কথাটি আমরা কেউই অস্বীকার করতে পারি না। অথচ সামাজিক ও অর্থনৈতিক বৈষম্যের কারণে অনেক মেধাবী ছাত্রছাত্রীকেই উচ্চ শিক্ষার দ্বারে এসে থমকে দাঁড়াতে হয়। অর্থনৈতিক সীমাবদ্ধতা প্রায়শই একজন শিক্ষার্থীর পড়াশোনার পথে সবচেয়ে বড় বাধা হয়ে দাঁড়ায়। বইপত্র কেনা, টিউশন ফি দেওয়া, এমনকি প্রতিদিনের যাতায়াতের খরচ জোগানোও কঠিন হয়ে পড়ে অনেকের জন্য।
অর্থনৈতিক সীমাবদ্ধতা যেন কখনো লেখাপড়ার পথে বাধা হয়ে না দাঁড়ায়, সেই উদ্দেশ্যে পশ্চিমবঙ্গ সরকার দ্বারা বিশেষভাবে রূপায়িত এই প্রকল্পটি সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ভুক্ত শিক্ষার্থীদের উচ্চশিক্ষার স্বপ্ন বাস্তবায়নে এক অনবদ্য হাতিয়ার।
ঐক্যশ্রী স্কলারশিপ চালু হওয়ার সাথে পশ্চিমবঙ্গের শিক্ষা ক্ষেত্রে এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা ঘটেছে। কেবলমাত্র আর্থিক সহায়তা প্রদানই নয়, এই বৃত্তি প্রকল্পটি মেধাবী ছাত্রছাত্রীদের অনুপ্রেরণা যোগিয়ে তাদের আত্মবিশ্বাস বৃদ্ধি করতেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এর ফলে স্কুলছুটের হার কমেছে এবং উচ্চশিক্ষায় সংখ্যালঘু ছাত্রছাত্রীদের উপস্থিতি উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে।
ঐক্যশ্রী স্কলারশিপ প্রকল্পের উদ্দেশ্য হলো পশ্চিমবঙ্গের সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের শিক্ষাগত উন্নয়নকে উৎসাহিত করা এবং তাদের অর্থনৈতিক সীমাবদ্ধতা কাটিয়ে উঠতে সাহায্য করা। প্রতি বছর, হাজার হাজার মেধাবী ছাত্রছাত্রী এই স্কলারশিপের জন্য আবেদন করে থাকে।
ঐক্যশ্রী স্কলারশিপ প্রকারভেদ
এই স্কলারশিপের দুটি ভাগ রয়েছে। যথাঃ
প্রিম্যাট্রিক স্কলারশিপ (Pre matric)
- এই স্কলারশিপের জন্য আবেদন করতে হলে ছাত্র-ছাত্রীকে প্রথম শ্রেণি থেকে দশম শ্রেণির মধ্যে থাকতে হবে।
- ছাত্র-ছাত্রীর পূর্ববর্তী বছরের পরীক্ষায় ৫০% নম্বর পেতে হবে।
পোস্ট ম্যাট্রিক স্কলারশিপ (Post matric)
- এই স্কলারশিপের জন্য আবেদন করতে হলে ছাত্র-ছাত্রীকে একাদশ শ্রেণি থেকে কলেজ স্তরের মধ্যে থাকতে হবে।
- ছাত্র-ছাত্রীর পূর্ববর্তী বছরের পরীক্ষায় ৫০% নম্বর পেতে হবে।
তবে এই পোস্ট ম্যাট্রিক স্কলার্শিপের আবার দুটো ভাগ আছে–
- সাধারণত কেউ যদি ৫০% শতাংশ নাম্বার পায় তাহলে তার জন্য ঐক্যশ্রী স্কলারশিপ।
- কিন্তু কোন ছাত্র বা ছাত্রী যদি ৬০% নাম্বার পায় তাহলে সে পাবে ঐক্যশ্রী স্বামী বিবেকানন্দ মেরিট স্কলারশিপ।
ঐক্যশ্রী স্কলারশিপ যোগ্যতা (Aikyashree Scholarship Eligibility)
- শিক্ষার্থীকে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের অন্তর্গত হতে হবে (যেমন- মুসলিম, খ্রিস্টান, বৌদ্ধ, শিখ, পার্সি, জৈন)।
- পশ্চিমবঙ্গের স্থায়ী বাসিন্দা হতে হবে।
- পূর্ববর্তী বার্ষিক পরীক্ষায় কমপক্ষে 50% নম্বর পেতে হবে।
- পারিবারিক বার্ষিক আয় 2 লক্ষ টাকার বেশি হতে পারবে না।
ঐক্যশ্রী স্কলারশিপ থেকে প্রাপ্ত টাকার পরিমাণ (Aikyashree Scholarship Amount)
ঐক্যশ্রী স্কলারশিপে শিক্ষার্থীরা তাদের পড়াশোনার স্তর এবং হোস্টেলে থাকার অবস্থানের ভিত্তিতে বিভিন্ন পরিমাণে বৃত্তি পাওয়ার যোগ্য।
ডে স্কলারদের ক্ষেত্রে
- প্রথম থেকে পঞ্চম শ্রেণীর জন্য বছরে সর্বোচ্চ ১,১০০ টাকা।
- ষষ্ঠ থেকে দশম শ্রেণীর জন্য বছরে সর্বোচ্চ ৫,৫০০ টাকা।
- একাদশ এবং দ্বাদশ শ্রেণীর সাধারণ কোর্সের জন্য বছরে সর্বোচ্চ ১০,২০০ টাকা।
- একাদশ এবং দ্বাদশ শ্রেণীর কারিগরি ও বৃত্তিমূলক কোর্সের জন্য বছরে সর্বোচ্চ ১৩,৫০০ টাকা।
- স্নাতক এবং স্নাতকোত্তর কোর্সের জন্য বছরে সর্বোচ্চ ৬,৬০০ টাকা।
- স্নাতকোত্তর, এম.ফিল এবং পিএইচডি কোর্সের জন্য বছরে সর্বোচ্চ ৯,৩০০ টাকা।
- মেডিকেল, ইঞ্জিনিয়ারিং, ম্যানেজমেন্ট, ল, চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্ট ইত্যাদি কোর্সের জন্য বছরে সর্বোচ্চ ২৭,৫০০ টাকা।
হোস্টেলে থাকা শিক্ষার্থীদের ক্ষেত্রে
- ষষ্ঠ থেকে দশম শ্রেণীর জন্য বছরে সর্বোচ্চ ১১,০০০ টাকা।
- একাদশ এবং দ্বাদশ শ্রেণীর সাধারণ কোর্সের জন্য বছরে সর্বোচ্চ ১১,৯০০ টাকা।
- একাদশ এবং দ্বাদশ শ্রেণীর কারিগরি ও বৃত্তিমূলক কোর্সের জন্য বছরে সর্বোচ্চ ১৫,২০০ টাকা।
- স্নাতক এবং স্নাতকোত্তর কোর্সের জন্য বছরে সর্বোচ্চ ৯,৬০০ টাকা।
- স্নাতকোত্তর, এম.ফিল এবং পিএইচডি কোর্সের জন্য বছরে সর্বোচ্চ ১৬,৫০০ টাকা।
- মেডিকেল, ইঞ্জিনিয়ারিং, ম্যানেজমেন্ট, ল, চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্ট ইত্যাদি কোর্সের জন্য বছরে সর্বোচ্চ ৩৩,০০০ টাকা।
উল্লেখ্য যে
- যে সমস্ত শিক্ষার্থীরা সংশ্লিষ্ট ইনস্টিটিউটের হোস্টেলে থাকেন না কিন্তু পেয়িং গেস্ট হিসেবে বা ভাড়ায় থাকেন, তাদেরও হোস্টেলারদের মধ্যেই অন্তর্ভুক্ত করা হবে।
- ভর্তি এবং টিউশন ফি বাস্তব সাপেক্ষে বিচার করে পরিবর্তিত হতে পারে।
- একটি শিক্ষাবর্ষে সর্বাধিক ১০ মাসের রক্ষণাবেক্ষণ ভাতা প্রদান করা হবে।
আরও স্কলারশিপঃ কোলগেট স্কলারশিপে ছাত্রছাত্রীরা পাবে ৭৫,০০০ টাকা, কিন্ত কারা পাবে এই বৃত্তি দেখে নাও চটজলদি
ঐক্যশ্রী স্কলারশিপ আবেদন প্রক্রিয়া (Aikyashree Scholarship Application)
ঐক্যশ্রী স্কলারশিপের আবেদন সম্পূর্ণ অনলাইনে করতে হবে। আবেদনের জন্য নিম্নলিখিত ধাপগুলি অনুসরণ করুন:
- প্রথমে wbmdfcscholarship.org ওয়েবসাইটে যান।
- “Apply Now” বাটনে ক্লিক করুন।
- নতুন রেজিস্ট্রেশন করতে “New User” বাটনে ক্লিক করুন।
- আপনার সকল তথ্য পূরণ করুন।
- আপনার ছবি এবং স্বাক্ষর আপলোড করুন।
- “Register” বাটনে ক্লিক করুন।
- আপনার রেজিস্ট্রেশন সফল হলে একটি ইমেল পাবেন।
- ইমেলে পাওয়া লিঙ্ক ব্যবহার করে আপনার অ্যাকাউন্টে লগ ইন করুন।
- “Apply Now” বাটনে ক্লিক করুন।
- আপনার সকল তথ্য পূরণ করুন এবং প্রয়োজনীয় ডকুমেন্টস আপলোড করুন।
- “Submit” বাটনে ক্লিক করুন।
প্রয়োজনীয় ডকুমেন্টস
- আবেদনপত্র
- ছবি
- স্বাক্ষর
- মাধ্যমিক বা সমমানের পরীক্ষার মার্কশিট
- অষ্টম শ্রেণির মার্কশিট
- বাবা-মায়ের বার্ষিক আয়ের সার্টিফিকেট
- স্থায়ী বাসিন্দা সার্টিফিকেট
- সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের সার্টিফিকেট
হেল্পলাইন নাম্বার: ঐক্যশ্রী স্কলারশিপ এর ব্যাপারে যদি আরও কিছু বিস্তারিত জানার থাকে তাহলে 18001202130 (Toll-Free), 033-4047468 হেল্প লাইন নাম্বারে যোগাযোগ করুন।
এই স্কলারশিপ সম্পর্কিত জিজ্ঞাসিত প্রশ্ন
প্রশ্ন: ঐক্যশ্রী স্কলারশিপ কে পাবে?
উত্তর: পশ্চিমবঙ্গের সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের দুঃস্থ পরিবারের মেধাবী ছাত্রছাত্রীরা এই স্কলারশিপের জন্য আবেদন করতে পারেন।
প্রশ্ন: ঐক্যশ্রী স্কলারশিপ থেকে কত টাকা পাওয়া যায়?
উত্তর: শিক্ষার স্তর এবং হোস্টেলে থাকার অবস্থানের উপর নির্ভর করে বৃত্তির পরিমাণ ভিন্ন হয়। সর্বোচ্চ বছরে ₹৩৩,০০০ টাকা পর্যন্ত পাওয়া যায়।
প্রশ্ন: ঐক্যশ্রী স্কলারশিপের জন্য আবেদন করতে কি কি নথিপত্র লাগবে?
উত্তর: আবেদনকারীর স্কুল/কলেজের ছাত্র-ছাত্রী পরিচয়পত্র, পূর্ববর্তী বছরের পরীক্ষার মার্কশিট, পরিবারের বার্ষিক আয়ের সার্টিফিকেট, পাসপোর্ট সাইজের ছবি প্রভৃতি নথিপত্র লাগবে।
প্রশ্ন: ঐক্যশ্রী স্কলারশিপের জন্য আবেদন করতে কোথায় যেতে হবে?
উত্তর: এই স্কলারশিপের জন্য আবেদন সম্পূর্ণ অনলাইনে করতে হবে। http://wbmdfcscholarship.org ওয়েবসাইটে গিয়ে আবেদন করতে পারেন।
প্রশ্ন: আমার পরিবারের আয় বেশি, কিন্তু অসাধারণ অর্থনৈতিক পরিস্থিতি রয়েছে। এই ক্ষেত্রে কি আমি আবেদন করতে পারি?
উত্তর: হ্যাঁ, আপনি আবেদন করতে পারেন। আয় সীমা ছাড়িয়ে গেলেও বিশেষ ক্ষেত্রে বিবেচনা করা হতে পারে। আপনার অসাধারণ অর্থনৈতিক পরিস্থিতি সম্পর্কে সঠিক তথ্য ও নথি সহকারে আবেদন করুন।
প্রশ্ন: আমি আগে এই স্কলারশিপ পেয়েছিলাম। আবারও আবেদন করতে পারি?
উত্তর: হ্যাঁ, আপনি আবারও আবেদন করতে পারেন। তবে, প্রতি বছর আপনার মেধা এবং আয়ের অবস্থা যাচাই করে নতুন করে স্কলারশিপ প্রদান করা হয়।
প্রশ্ন: আমি অন্য রাজ্যের স্থায়ী বাসিন্দা, কিন্তু পশ্চিমবঙ্গে পড়াশোনা করছি। এই ক্ষেত্রে কি আমি আবেদন করতে পারি?
উত্তর: না, শুধুমাত্র পশ্চিমবঙ্গের স্থায়ী বাসিন্দারাই ঐক্যশ্রী স্কলারশিপের জন্য আবেদন করতে পারেন।
প্রশ্ন: ঐক্যশ্রী স্কলারশিপের জন্য আবেদনের শেষ তারিখ কবে?
উত্তর: প্রি-ম্যাট্রিক স্কলারশিপের জন্য আবেদনের শেষ তারিখ প্রতি বছর ৩০ জুন এবং পোস্ট-ম্যাট্রিক স্কলারশিপের জন্য আবেদনের শেষ তারিখ প্রতি বছর ৩১ ডিসেম্বর।
প্রশ্ন: আবেদন করার সময় কোনো সমস্যা হলে কার সঙ্গে যোগাযোগ করব?
উত্তর: wbmdfcscholarship.org ওয়েবসাইটে বা হেল্পলাইন নাম্বারে যোগাযোগ করে আরও তথ্য জানতে পারেন। হেল্পলাইন নাম্বার: 18001202130, 033-4047468